Pranab Barua Arnab
লেখার শিরোনাম দেখে কত কিছুই না মনে হতে পারে। আমাদের ছোট জীবন, অথচ জীবনের পরতে পরতে কত ঋণ। কেউ কী আমরা ভেবে দেখেছি। মানুষের জীবনের সফলতা আর ব্যর্থতার নানান গল্প শুনেছি কিংবা পড়েছি। কিন্তু ওঠে দাঁড়ানোর কিংবা ঘুরে দাঁড়ানোর কথা খুব কম মানুষই বলে। যার হাত ধরে উঠে দাঁড়ালো, তাঁর ঋণ স্বীকার না করে তাঁর প্রতি তাচ্ছিল্য প্রকাশ করে। ক্ষেত্র বিশেষে তার পেছনেও লেগে পড়ে। ঋণ স্বীকারে কুণ্ঠিত হই।
অথচ পৃথিবীর আলো দেখানো পিতা-মাতার প্রতিও আমরা ভালো ব্যবহার করি না, যথাযথ দায়িত্ব পালন করি না। জাগতিক জীবনে আমিত্ব পেয়ে বসে। কোথা থেকে আমার শুরু কিংবা কোথা থেকে এলাম, আমার এখানে আসার পেছনে কে বা কারা স্বীকার করতে চাই না। প্রচ্ছন্নভাবে একুরিয়ামের গোল্ড ফিশের জীবন গ্রহণ করি। তবে আর জে কিবরিয়ার ” জীবনের গল্প’ আমাকে অনুপ্রেরণা জোগায়।
সেখানে অনেকেই তাদের ওঠে দাঁড়ানোর গল্পে অকপটে স্বীকার করে তাদের ওঠে আসার পেছনের মানুষদের অবদানের কথা। তারা না হলে আজকের অবস্থান আসা সম্ভব হতো না।
সে সব জীবন গল্প অনুপ্রেরণার পাশাপাশি আলোড়িত করে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা ভুল যাই, সে সব মহানুভব মানুষদের। যাদের ত্যাগে ওঠে দাঁড়ানো সেই সব মানুষদের।
২০০৪ সালের অক্টোবর মাসের মনখারাপ করা সন্ধ্যা। হতে পারে ওই মাসের দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় সপ্তাহ। স্পষ্ট অান্দরকিল্লা, কণিকা ফোন,ফ্যাক্স ফটোস্ট্যাটের দোকান মানে সাংবাদিক কাঞ্চন দাদার দোকানে বসে আছি। বলে রাখা ভালো, সে সময়ে এবং তারও আগে সাংবাদিকদের সংবাদ প্রেরণের জন্য বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান কনিকা ইন্টারন্যাশনাল। কাঞ্চন দাদা দোকানে এসে আমার মন খারাপ করে বসে থাকতে দেখে মন খারাপের বিষয়টি জানতে চান। বিষয়টি যখন বলছিলাম তখন অশ্রু সজল হয়ে উঠে ছিল, তিনি অভয় দিলেন,তার কাছে সব কথা খুলে বললাম। কথা শেষ হতেই সেখানে এসে উপস্থিত হলেন শ্রদ্ধেয় মামা দৈনিক আজাদীর প্রবীণ সাংবাদিক বিমলেন্দু বড়ুয়া। তিনি চেহারার অবস্থা দেখে জিজ্ঞেস করলেন, ভাগিনার মন খারাপ। আমার উত্তর কাঞ্চন দাদা দিয়ে দিলেন। সাংবাদিক বিমলেন্দু মামা সাহস ও অভয় দিলেন, দেখি কাল সকালে বাসা আসবি, আমি দৈনিক আজাদীর সম্পাদক তথা মালিক মালেক সাহেবের সাথে কথা রাখবো। মামার সেদিনের সেই কথায় মনে সাহস যুগিয়েছে ঠিকই,কিন্তু হেরে যাওয়া কিংবা বন্ধুদের মধ্যে থেকে কেউ অপপ্রচার করে হারিয়ে দেয়া মন থেকে মেনে নিতে পারিনি। তাই কাঞ্চন ( প্রয়াত) দাদাকে বলি যেখানে দাঁড়াতে পারিনি সেখানে দাঁড়াবো প্রয়োজনে সংবাদকর্মী নয়, পিয়নের চাকরি হলেও আমি আছি। যারা আমার নিয়োগ ঠেকিয়েছেন তাদের চা আর পানি খাওয়া বো,একদিনের জন্য হলেও ওই প্রতিষ্ঠান চাকরি চাই। যে কথা সে কাজ, দাদা লোক খুঁজে বের করে ফেললেন। কাল সকালে যোগাযোগ হবে, উনি বাড়ি চলে গেছেন। আমার তো আর তর সয় না। কখন সকাল হবে,কখন উনার সাথে দেখা হবে। আবার এদিকে বিমলেন্দু মামার বাসায় যেতে হবে। কোনটা আগে করি। মামার বাসায় গিয়ে আবেদনপত্র দেখালাম, তিনি সুপারিশ করে দিলেন। জানালেন, দৈনিক আজাদীর সম্পাদক সাহেবকে বলেছেন। এবার তুমি দেখা কর, মামাকে জানলাম ক”দিন পরে যাবো। তার আগে আরেকটি মিশন আছে, সে মিশন শেষে যাবো। মামার বাসা থেকে বিদায় নিয়ে আবারও কাঞ্চন দাদার দোকান। সকাল গড়িয়ে দুপুর কখন দেখে হবে, তাঁর সাথে। সময় তো শেষ হয় না, কাঞ্চন দাদার বাসায় খেয়ে ফোনে যোগাযোগ করা হল। তিনি জানালেন, সাড়ে চারটার সময় জিইসির মোড়ে থাকতে।
আমরা পৌঁছালাম। তিনিও আসলেন। একজন সাদামাটা মানুষ। বয়সের ভারে ন্যুয়ে পড়েছেন। দেখে ভক্তি ও শ্রদ্ধা আসলেও মনের মাঝে শংকা দেখা দিয়েছে, তাঁর কথা তিনি রাখবেন। সহজ সরল এই মানুষটি কি সত্যি আমার ত্রাতা হয়ে উঠবেন। তিনি আর কেউ নন, বাবু আশুতোষ বড়ুয়া। তিনি একজন সাধারণ মানুষ। তাঁর কাছে ছিলেন বিশ্বস্ত। সেই মানুষটি দেখার পরে নানা চিন্তা মাথার খেলে যাচ্ছে। এরও আগে দুবারও সুযোগ পেয়েছিলাম। পছন্দের পদ পায়নি বলে করা হয়ে ওঠেনি। এবারও পেয়ে হারালাম, বন্ধু নামের একজনের কারসাজিতে। তাই ভয় আর শংকা ছিল। সড়কেই তাঁকে পা ছুঁয়ে নমস্কার করে মামা ডাকলাম। নিরিবিলি হোটেলে বসলাম। এরিমধ্যে কাঞ্চন দাদা সব খুলে বললেন, তিনি সব শুনে বললেন, কাল সকাল ৮টায় গিয়ে তাঁর সাথে দেখা করে আমার কথা বলবেন,’ আমি আশুতোষের ভাগিনা’। হোটেল থেকে মামাকে বিদায় জানিয়ে, আমরা ফিরলাম আন্দরকিল্লা। তখন আমার বাসা ছিল শপিং সেন্টারের অপরপাশে ডেইলিলাইফ গলিতে। পরদিন সকালে চট্টগ্রামের আধুনিক সংবাদ পত্র তথা ‘দৈনিক পূর্বকোণ’ এর জনক জনাব ইউসুফ চৌধুরীর সাথে দেখা করে আমার পরিচয় তুলে ধরা। যথা নিয়মে দৈনিক পূর্বকোণ অফিসে পৌঁছে, জনাব ইউসুফ চৌধুরীর সাথে দেখা করার জন্য তাঁর ব্যক্তিগত অফিস সহায়ক জানলাম।আমি একটু দেখা করতে চাই। বললেন, অপেক্ষা করতে। বলে রাখা ভালো, এই মহিরুহের সাথে এটি নিয়ে আমার দ্বিতীয়বারের মত দেখা হবে। কিছুক্ষণ পর ডাক আসলো, সালাম জানিয়ে কথা বলতে যাওয়ার আগেই তিনি বলে উঠলেন, তোয়ারে কইলাম আয়র এডে পদ খালি নাই, তখন আমি সে কথা না শুনে শুধু বললাম, আমি “আশুতোষ” বাবুর ভাগিনা। তিনি বলে উঠলেন, এতদিন এ কথা ন ক কা।
তারপর তিনি ফোন টেনে নিয়ে, হাসনাত (এ এইচ এম হাসনাত মোর্শেদ তথা হাসনাত ভাই) কে ডেকে আনলেন। বললেন, দেখ, কাজ পারে কিনা। হাসনাত সাহেবকে অনুসরণ করে দৈনিক পূর্বকোণের দোতলায় উঠে গেলাম। রুমের একপাশে গোলাকার টেবিলে কাজ করছেন শওকত ওসমান, সঞ্জয় মহাজন কল্লোল (প্রয়াত), অন্য পাশে জনাব আবু তাহের মুহাম্মদ ও ইউসুফ সবুর। নগর ডেস্ক আর মফস্বল ডেস্ক। এ এইচ এম হাসনাত মোর্শেদ সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন, কাজ দিলেন। কিছুক্ষণ পর হাসনাত মোর্শেদকে আবারও ডেকে নিলেন, জিজ্ঞেস করলেন কাজ পারবে কিনা। তিনি জানালেন পারবে,এর কিছুক্ষণ পর আমার ডাক আসলো, সালাম জানিয় ভিতরে প্রবেশ করতেই মনোযোগ সহকারে কাজ করতে বললেন, সময় মেনে অফিসে আসা-যাওয়া করতে নিদেশনা দিলেন । চাকরি হয়ে গেল, যার ঠেকিয়ে ছিলেন, তারা বুঝে উঠতে পারেননি আমার পেছনের মানুষটি কে?
খুশির খবরটি প্রথমেই আশুতোষ মামাকে জানালাম, তারপর কাঞ্চন দাদাকে। এরপর বিকেলে বিমলেন্দু মামাকে জানালাম। আমি জানানোর আগে কাঞ্চন দাদা জানিয়ে দেন। দৈনিক পূর্বকোণে চাকরি নেয়ার একমাসের মাথায় দৈনিক আজাদীতেও চাকরি ব্যবস্থা করেন বিমলেন্দু মামা। যদিও আজাদীতে যাওয়া হয়ে ওঠেনি।
তবে দৈনিক পূর্বকোণ সম্পাদক তথা চট্টগ্রামের আধুনিক সংবাদপত্রের জনক জনাব ইউসুফ চৌধুরীর কাছে কত মূল্যবান মানুষ ছিলেন আশুতোষ বড়ুয়া সেদিনই বুঝে ছিলাম। একজন সাধারণ, অতি সাধারণ মানুষ মালিকের কত আস্থাভাজন ও বিশ্বস্ত হলে তাঁর নাম বলার সাথে সাথে দু কথা চিন্তা না করেই চাকরি দিয়ে দিতে পারেন। বাবু আশুতোষ বড়ুয়া আমার চাকরিকালিন সময়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তোমাকে কত বেতন দিলে পোষাবে। বলেছিলাম আপনি ঠিক করে দিয়েন,তবে আমার আগে যে দু’জন জয়েন্ট করেছে তাদের থেকে একটু বেশি। তিনি সে কথা অনুসারে আমার বেতন ঠিক করে দেন,পরে জিজ্ঞেস করেছিলেন, পোষাবে কীনা। তারপর তাঁর সাথে মাঝে মধ্যে অফিসে দেখা হত। প্রথম মাসের বেতন তুলে তাঁকে খাওয়ানোর জন্য কাঞ্চন দাদাসহ অনুরোধ করেছিলাম,তিনি খাননি। শুধু চা খেয়ে ছিলেন। তখন বলেছিলাম আজকে থেকে আমিও আপনার সন্তান, কখনও কোন কাজে লাগলে নিঃসংকোচে বলবেন।
সেদিন হোটেল বসে নানান কথা বলেছিলেন, নিউজ ফ্রন্ট থেকে তাঁর শুরু। কিভাবে আপনার উপর এত আস্থা। সাদাসিধা জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত, সারিল্য ভরা জীবন, আমার মত কতজনের উপকারি স্বজন আশুতোষ বড়ুয়া। তারও কিছু দিন পরে তিনি মৃত্যু বরণ করেন। এ জীবনে এরকম মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। পরপারে ভালো থাকুন শ্রদ্ধেয় আশুতোষ মামা, কাঞ্চন দাদা ও সংবাদ পত্রে আমার মহিরুহ বিমলেন্দু মামা। আশুতোষ মামার ঋণ এ জীবনে শোধ করা যাবে না, চেনা নেই, জানা নেই তিনি কত সহজে আমাকে ভাগিনা বলে পরিচয় দিয়েছিলেন। রক্তের সম্পর্ক ছিলো না, অথচ কত সহজে তিনি আপন করে নিয়েছিলেন। অসাধারণ মনের মানুষ। ওপারে ভালো থাকুন।
ফেসবুক পেইজ থেকে সংগ্রহীত