খন রঞ্জন রায়
প্রতি বছর ১৪ই মার্চ সারাবিশ্বে পালন করা হয় আন্তর্জাতিক নদীকৃত্য দিবস। নদীর স্বাভাবিক গতিধারা, প্রবাহ, সচলতার প্রতিবন্ধকতা, বাঁধ নির্মাণ প্রতিরোধে জনসচেতনতা সৃষ্টির উদ্দেশ্য আজকের এই দিবস।
নদী রক্ষায় সংগ্রাম, সোচ্চারকণ্ঠ, সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা, সহমর্মিতা, উৎসাহ ও সহযোগিতা বৃদ্ধিকল্পে জনগুরুত্বের এই দিন। প্রবাহিত জলের যে প্রাকৃতিক রূপ, ধারায়, উপধারায় পৃথিবীর মানচিত্র জুড়ে বিস্তৃতি তাকে আমরা বলি নদী বা নদী-ব্যবস্থা । নদীর গঠনে-চলনে জল ছাড়াও যে প্রাকৃতিক বস্তুটির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ সেটি মাটি। জলের হাত ধরে চলা এই মাটির নানা রূপ, নানা চরিত্র, নানা ধর্ম। ‘ভূ-পৃষ্ঠ’ বা ‘ভূমি’ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর জল বিশেষ বিশেষ মাটির গঠনে তৈরি। জল-মাটির ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় গড়ে ওঠা নদীরপাড় মাটির নানা চরিত্র প্রকাশ করে। নদীর জলে গড়িয়ে বা ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া নুড়ি-পাথর-বালি-কাদা, মাটির গড়ন ও চলনকে গভীরভাবে বুঝতে সাহায্য করে। উপলব্ধি করে নিতে হয়।
অপরিসীম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার আমাদের এই পৃথিবী। এই সৌন্দর্যের গুরুত্বপ‚র্ণ অংশ জুড়ে আছে গাছপালা-ফুল-পাখি-নদী-জল। পৃথিবীর নানা প্রান্তে জালের মতো জড়িয়ে আছে নানা নদ-নদী। কোনো কোনো নদী দেশ-কাল আর জাতির সীমা ছাড়িয়ে পেয়েছে বৈশ্বিক রূপ। এসব নদীর সৌন্দর্য যেমন যে কাউকে বিমোহিত করে, তেমনি ভৌগোলিক ভারসাম্যে এদের অবদান অনস্বীকার্য। কোনোটি ঐতিহাসিকভাবে বিখ্যাত, কোনোটি আবার দৈর্ঘ্যরে দিক থেকে সর্ববৃহৎ। নদী রাজনৈতিক সীমারেখা না মানলেও ভৌগোলিক অবস্থানে বিশ্বের প্রায় ৮৬ শতাংশ দেশ কোন না কোন আন্তর্জাতিক নদী অববাহিকার অংশ।
বিশ্বে প্রায় ২৭৬ টি আন্তঃসীমান্ত নদী অববাহিকা আছে, যার প্রায় ২৩ শতাংশ আফ্রিকায়, ২২ শতাংশ এশিয়ায়, ২৪.৫ শতাংশ ইউরোপে, ১৬.৫ শতাংশ উত্তর আমেরিকায় এবং ১৪ শতাংশ দক্ষিণ আমেরিকায়। আন্তর্জাতিক পরিসরে পানি ব্যবস্থাপনার সহযোগিতার জন্যে নদী অববাহিকার দেশগুলোর মানসিকতা, মানবিকতা, সহমর্মীতার যুথবদ্ধ ঐক্য গড়ে ওঠছে। ‘আমার দেশ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বলে এর উপর একমাত্র আমারই অধিকার’ এই মানসিকতা থেকে সরে আসতে হচ্ছে। ১৯৯৭ সালে গৃহীত প্রস্তাবিত নৌচলাচলে জাতিসংঘের কনভেনশন কার্যকর করার চেষ্টা হচ্ছে। বাংলাদেশের বেলায় এই আইন অতি প্রয়োজনের। আমাদের ৯১ শতাংশ পানি আসে আন্তর্জাতিক নদীর মাধ্যমে। জাতিসংঘের প্রস্তাবিত এই কনভেনশন কার্যকর করার সর্বাত্ত¡ক চেষ্টা তদ্বির আমাদেরই করা উচিত।
নদী, পানি, ভূ-রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যে বাংলাদেশের অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বে যত বড় নদী আছে তার মধ্যে বাংলাদেশের মেঘনা নদীর পানিই সবচেয়ে স্বচ্ছ, বিশুদ্ধ এবং নিরাপদ। চীনের হোয়াংহো বা ইয়েলো নদীর পানি সবচেয়ে খারাপ। ইউরোপের রাইন নদীর পানি এখনো বিষাক্ত। এছাড়া সাউথ আমেরিকার আমাজান এবং বাংলাদেশের গঙ্গা ও যমুনা নদীর পানির মান ভালো নয়। বিশ্বের বড় বড় নদীর ওপর পরিচালিত এক আন্তর্জাতিক গবেষণায় এ তথ্য প্রকাশ পেয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ওরিগন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. উইলিয়াম হোলস্যারের নেতৃত্বে দশ সদস্যের এক বিজ্ঞানী দল প্রায় ২০ বছর ধরে এ গবেষণা করেন। গবেষকদল মিসিসিপি, আমাজান, নীল নদ, রাইন, হোয়াংহো, গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা, ইন্ডাস ও ম্যাকং- বিশ্বের এই বড় নদীগুলোর পানি পরীক্ষা করেছেন। তাতে দেখেছেন মেঘনা নদীর পানিই স্বচ্ছ ও নিরাপদ। এ কারণে মেঘনা মাছের জন্য খুবই উপযুক্ত আবাসস্থল। রুই-কাতলার সবচেয়ে উপযুক্ত এই মেঘনা নদী। শীতেও কোন ব্যাত্যয় ঘটে না, পাওয়া যায় রিঠা মাছ।
কেবল মেঘনা নয়, পুরো বাংলাদেশ পানিতে ভাসা দেশ। সাগর থেকে জাগা দেশ। অবিরাম বৃষ্টিপাতের দেশ। উজান থেকে বয়ে আসা পলিমাটির দেশ। উত্তরের সুউচ্চ হিমালয় পর্বতমালা থেকে দক্ষিণের সাগরপারের বনভ‚মি পর্যন্ত বিস্তৃত পৃথিবীর উর্বরতম দেশ। এখানে সারা বছর ফসল হয়, মাছ হয়। জমিতে ধান, গাছে ফল। এই কারণে সুজলা-সুফলা এই বাংলা পৃথিবীর ঘন বসতিতম দেশ। এর সমতল পলিমাটির বুক চিরে বয়ে চলছে অজস্র নদনদী। বাংলার সেই রূপে এখন দ‚ষণে পরিপ‚র্ণ শহরাঞ্চলের নদীগুলো দুর্গন্ধময় বিষাক্ত শিল্পবর্জ্যে প‚র্ণ। গ্রামাঞ্চলের নদীগুলো মরা, যেখানে আগে বৈশাখ মাসেও হাঁটুজল থাকত। বিল ও জলাভ‚ মিগুলো অতি নিষ্কাশনে শুষ্ক। নদীগুলো খুব দ্রæত নাব্যতা হারাচ্ছে। একসময় যেসব নদী বেশ খরস্রোতা ছিল, সেগুলোও এখন মরা নদীতে পরিণত হয়ে তাদের চরিত্রই হারিয়ে ফেলছে। পুরনো ব্রহ্মপুত্র আজ মৃতপ্রায় স্রোতস্বিনী। পদ্মা ও যমুনার বুকেও জেগে উঠছে চর। সুরমা, কুশিয়ারা, চিত্রাসহ দেশের অসংখ্য নদ-নদী আজ দুর্বল হয়ে পড়েছে। বর্ষাকালে এগুলো নৌ চলাচলের উপযোগী থাকলেও, শীতের শুরুতেই এগুলো নাব্যতা হারায়। গ্রীষ্মকালে অনেক নদী স্থানে স্থানে সম্পূর্ণ শুকিয়ে যায়।
সমীক্ষায় দেখা গেছে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে মোট নদীপথ ছিল ২৪ হাজার ১৪০ কিলোমিটার, ১৯৮৪ সালে তা কমে দাঁড়ায় আট হাজার ৪৩৫ কিলোমিটারে। ১৯৯২ সালে কমে নৌপথের পরিমাণ দাঁড়ায় পাঁচ হাজার ৮৯৬ কিলোমিটারে এবং বর্তমানে নদীর পানিপ্রবাহ কমে তা দাঁড়িয়েছে মাত্র তিন হাজার ৮০০ কিলোমিটারে। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, এ অবস্থা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের নদীগুলোয় ৩০ শতাংশ পানি প্রবাহ কমে যাবে এবং সেক্ষেত্রে আরো ১০০টি নদী নাব্যতা হারাবে। নদীগুলোর নাব্যতা হারানোর মূল কারণই হলো নদীবক্ষে পলি জমে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়া। আমাদের নদীগুলোয় সাধারণত অক্টোবর মাস থেকেই পানিপ্রবাহের গতি কমতে থাকে। ফলে নদীর পলি বহনের ক্ষমতাও হ্রাস পায়। প্রবাহের গতি ও পানির ঘূর্ণন কমে যাওয়ায় পলিমাটি আস্তে আস্তে নদীর তলদেশে জমতে থাকে বেশ কয়েক বছর এভাবে একই স্থানে পলি জমার পর ওই স্থানে চর জেগে ওঠে এবং নদীর নাব্যতা হ্রাস করে।
প্রাকৃতিক কারণের পাশাপাশি মানুষের সৃষ্ট কারণও কম দায়ী নয়। নদীর উজানে বনভ‚মি উজাড় করার ফলে পলিপ্রবাহ বৃদ্ধি পায় এবং অতিরিক্ত পলি নদীর তলদেশে জমা হয়ে নদী ভরাট-প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়। মানুষ নদীর পানিতে শিল্পবর্জ্যরে নিঃসরণ ঘটাচ্ছে। এসব শিল্পবর্জ্যরে রাসায়নিক অংশ নদীর পানি দ‚ষণের পাশাপাশি বর্জ্যরে অদ্রবণীয় অংশ শুষ্ক মৌসুমে নদীর তলদেশে জমে নদীর নাব্যতা হ্রাস পাচ্ছে। অতিলোভী ও সম্প‚র্ণ বিবেকবর্জিত কিছু মানুষ অনেক নদ-নদীর তীর দখল করে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করার কারণেও অনেক নদীর প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়ে নদীর নাব্যতা হ্রাস পেয়েছে। এ ছাড়া উজানে বাঁধ নির্মাণ, পাহাড় কাটা, পাহাড়ি জমিতে কৃষিকাজ, অপরিকল্পিত পাড় বাঁধাই ও যত্রতত্র বালু উত্তোলনের কারণেও নদীর নাব্যতা হ্রাস পাচ্ছে।
বিশ্বের মেগাসিটি দেশের রাজধানী ঢাকাকে ঘিরে রেখেছে চারটি নদী বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালু। এ চারটি নদীকে বলা হয় ঢাকার প্রাণ। বিগত কয়েক বছর ধরে মারাত্মকভাবে দূষণের শিকার এ চারটি নদীই পরিবেশগত সঙ্কটাপন্ন। অবৈধ স্থাপনা, কলকারখানার দূষিত পদার্থ ও নগরবাসীর ত্যাজ্য বর্জ্যে নগরগুলোর মৃত্যু হচ্ছে। এসব নদীর পানি বিষাক্ত, কালো রঙের। এর মধ্যে বুড়িগঙ্গা সবচেয়ে বেশি সঙ্কটাপন্ন। রীতিমতো বিষাক্ত বর্জ্যরে বহমান আধারে পরিণত হয়েছে। ক্রমাগত দূষণের কারণে নদী তীরবর্তী জনজীবনের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিকল্পিতভাবে পদক্ষেপ নিলে ঢাকার চারটি নদীকে বাঁচানো সম্ভব। তারা দেখিয়েছেন অতীতে লন্ডন শহর পার্শ্ববর্তী টেমস নদীর পানি মারাত্মকভাবে দূষিত হয়েছিল। ১৮৩৩ সাল থেকে ১৮৮৬ সাল পর্যন্ত টেমস নদীর ভয়াবহ দূষণের কারণ চারবার মহামারী কলেরা ছড়িয়ে পড়েছিল এবং এর ফলে নদীর তীরবর্তী এলাকায় প্রায় ৩৫ হাজার লোকের মৃত্যু হয়েছিল। তখন বিশেষজ্ঞদের নির্দেশনা অনুযায়ী টেমস নদীর পানি শোধনের কারণে নদীর পানি আগের অবস্থায় ফিরে আসে। আমাদের দেশেও নদীগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রায়ই ড্রেজিংয়ের কথা বলা হয়, গল্প সাজানো হয়। সাধারণ মানুষের কাছে এই গল্প খুবই আকর্ষণীয়। অধিকাংশ মানুষ ম‚ল ব্যাপারটি না বুঝেই এ ধরনের প্রকল্পের প্রতি উৎসাহ প্রকাশ করে। গবেষণায় দেখো গেছে মৃত নদীকে বাঁচানো যায় না।
নদীপথগুলোকে সচল রাখার জন্য যেসব পথে চর পড়ে, সেগুলো সরানোর জন্য ড্রেজিং প্রয়োজন। অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন সংস্থার (বিআইডব্লিউটিএ) দায়িত্বের সঙ্গে তা পালন করে। প্রকৃতিগতভাবেই ভাটিতে থাকায় বাংলাদেশের নদী অনেক দুর্বল। তেজ কম। নদী উদ্দাম থাকলে,স্রেতধারা থাকলে অনায়াসে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা যায়। বাংলাদেশ এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত। বিশেষ করে উজানের দেশ ভারত সেক্ষেত্রে সুবিধাভোগী। নদী ভাবনা সব দেশেই আছে। মানুষের মরা-বাঁচা তার ওপর। দরিয়া শীর্ণ হলে দেশ, দুর্বল। পৃথিবীর মাত্র একাংশ স্থল, তিন ভাগ সলিল। বিশাল সমুদ্রের এক ফোঁটাও তেষ্টা মেটানোর জন্য নয়। গাছপালাও তা গ্রহণে অপারগ। পরিবহনের ক্ষেত্রে তো নদী সাশ্রয়ী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আকাশ, রেল, সড়ক থেকে নদী পরিবহনে বাংলাদেশের গুরুত্ব এখনও বেশি। পরিবহনের তিন-চতুর্থাংশ নদীপথে পরিচালিত হয়। অন্য এক হিসাবে সারা বছর নদীপথের পরিমাণ থাকে ৫,৬৩২ কিলোমিটার। বর্ষাকালে সেটা বেড়ে দাঁড়ায় ৮,৯৪৫ কিলোমিটার। নদীমাতৃক বাংলাদেশের জন্য আসলেই বেদনার, কষ্টের, উদ্বেগের।
আমাদের শৈশবে দেখা বাদাম ওড়া নৌকোয় দূরপাল্লার যাত্রা এখন রূপকথার মতো! আধুনিকতার কড়াল গ্রাসে হারিয়ে যাচ্ছে সোনালি সব ঐতিহ্যের আকর। নদীগুলো দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে নাব্যতা হারিয়ে দিন দিন নিষ্পেষিত হয়ে মৃত্যুর কোলে ধাবিত হচ্ছে। দু’পাড়ে দোল খাওয়া কাশফুলের সঙ্গে যে নদীতে মনের কথা বলে আকাশে ওড়ার স্বপ্ন দেখতাম সেই পাড়গুলোয় এখন ইটপাথরের জঙ্গল আর ভূমিদস্যুদের আধিপত্যে, দখলে। জ্যোৎস্নারাতে রুপালি আলোর প্রতিবিম্ব যখন নদীর সুশীতল বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে কুটুম চাঁদকে ডাকতো, মনে হতো আমরা স্বর্গে বাস করি। এখনও তা কল্পনা করি।
মানুষের অবহেলা ও অপব্যবহার এবং প্রকৃতির ভারসাম্যহীনতা নদীকে দিন দিন কোণঠাসা করে ফেলছে। অহর্নিশ নদী হারিয়ে ফেলছে তার আপন রূপযৌবন। গবেষণায় প্রমাণিত নদী জীবন্ত সত্ত্বা। এই সত্ত¡া যদি একবার মৃত হয়ে যায়, তবে সমাজ সংস্কৃতি ও সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যাবে। পৃথিবীতে এমন অনেক নজীর বিদ্যমান। হরপ্পা মোহজেদারোসহ নানা সভ্যতা নদীর পাশেই ছিল। মানুষের নির্মমতাই এই সকল সভ্যতা ধ্বংস হয়ে গেছে। আমরা যদি জীবন্ত নদীকে বাঁচিয়ে রাখতে না পারি তবে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে নির্মম পরিস্থিতি। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নিদারুণ পরিণতি। মূল্যবান যেসব নদী হারিয়ে গেছে তার চিন্তা মাথায় রেখে, যেগুলি কঠিন ব্যাধিতে আক্রান্ত তাঁদের বাঁচানোর সিদ্ধান্ত এখনই নিতে হবে। আমার জীবদ্দশায় দেখা প্রাণচঞ্চল জীবন্ত নদীগুলি রোগাক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর প্রতীক্ষায় থাকার মতো অবস্থা হবে। এখানে আশারও কিছু কথা আছে। নদী জীবন্ত সত্ত্বা হিসাবে আমাদের হাইকোর্টও রায় প্রদান করেছেন। তুরাগ নদী নিয়ে করা মামলার এই ঐতিহাসিক রায় হয়েছিল ৩০ জানুয়ারি ২০১৯। ঐতিহাসিক এই রায় বাস্তবে প্রতিফলনের সাথে আন্তর্জাতিক অভিন্ন, আন্তঃসংযোগ নদীগুলি নিয়েও ভাবনার বান নিক্ষেপ করতে হবে।
অভিন্ন নদীগুলোতে ভারতের একতরফা বাঁধ তৈরি বা গতিপথ পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের অধিকাংশ নদী শীতকালে প্রায় সম্পূর্ণরূপে শুকিয়ে যায়। এককালের প্রমত্তা পদ্মা তখন হেঁটে পার হওয়া যায়। তিস্তা, ব্রহ্মপুত্রসহ অন্যান্য নদীরও একই অবস্থা। আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প দ্রæত বাস্তবায়নে ভারতের সুপ্রিমকোর্টের নির্দেশনা বাংলাদেশের জন্য মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে। আন্তর্জাতিক নদী আইনের স্বীকৃত সব রীতিনীতির প্রতি নিদারুণ উদাসীনতা প্রদর্শন করে কিছু প্রকল্প দ্রæত বাস্তবায়ন করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে এই প্রকল্পে। যেসব নদীর সংযোগ বাংলাদেশে সংকট সৃষ্টি করবে: ১. ব্রহ্মপুত্রের উপনদী মানোস-সংকোশ-তিস্তা-গঙ্গা সংযোগ, ২. কোশী-ঘাগরা-যমুনা-রাজস্থান সংযোগ, ৩. গন্ডক-গঙ্গা সংযোগ, ৪. ঘাদরা-যমুনা সংযোগ, ৫. সারদা-যমুনা সংযোগ, ৬. যমুনা-রাজস্থান সংযোগ, ৭. রাজস্থান-সাবরমতী সংযোগ, ৮. চুনার শোন ব্যারাজ সংযোগ, ৯. মোন ব্যারাজ ও গঙ্গার দক্ষিণের শাখাগুলোর মধ্যে সংযোগ, ১০. গঙ্গা-দামোদার-সুবর্ণরেখা সংযোগ, ১১. সুবর্ণরেখা-মহান্দী সংযোগ, ১২. কোশি- মেচী সংযোগ, ১৩. ফারাক্কা-সুন্দরবন সংযোগ, ১৪. ব্রহ্মপুত্র-গঙ্গা সংযোগ, ১৫. মহান্দী (মনিভদ্র)- গোদাবরী (ধলেশ্বর) সংযোগ, ১৬. গোদাবরী (ইনচমপল্লী)-নার্গাজুন সাগর সংযোগ, ১৭. গোদাবরী (পোলাভারম)-বিজয়ওয়ালা সংযোগ, ১৮. কৃষ্ণা (আলামান্ডি)- পেননার সংযোগ, ১৯. কৃষ্ণ (শ্রীমইলাম)- পেননার সংযোগ, ২০. কৃষ্ণা (নার্গাজুন সাগর)- সোমশিলা সংযোগ, ২১. পেন্না (সোমশিলা)-কাবেরী (গ্রান্ড অ্যানিকুট) সংযোগ, ২২. কাবেরী (কন্ডালাইয়া)-ভাইগাই-গুণ্ডুর সংযোগ, ২৩. কেন- বেতওয়া সংযোগ, ২৪. পার্বতী-কালী-সিন্ধু-চম্বল সংযোগ, ২৫. পার-তাপ্তী-নর্মদা সংযোগ, ২৬. দামন গঙ্গা-পিঞ্জল সংযোগ, ২৭. বেদাতি-ভার্গা সংযোগ, ২৮. নেত্রাবতী- হেমবতী সংযোগ, এবং ২৯. পদ্মা-আচান কোভেলী-ভাইপ্পার সংযোগ। এইসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের ওপর মারাত্মক আর্থ-সামাজিক ও পরিবেশগত নেতিবাচক প্রভাব পরবে। এ প্রকল্পের কারণে বাংলাদেশের নদী ব্যবস্থায় ভয়াবহ প্রকৃতিগত পরিবর্তন সাধিত হবে। আন্তর্জাতিক নদীকৃত্য দিবসের গুরুত্বই এখানে। সহযোগিতার হাত প্রসারিত করা। একে অপরের চাহিদার বিপরীতে পারস্পরিক যোগান নিশ্চিত করা। স্থানীয় পর্যায় থেকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নিজেদের অধিকারকে তুলে ধরা।
সার্বিক পরিস্থিতি চিন্তা করে এখনই একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করা। নদীর অধিকার যদি আদায় করা না যায় তবে এ দেশ ২০৩০ সালের দিকে বসবাসের অনুপযুক্ত হয়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে। পানি সংকট পারমাণবিক সংকটের ভয়াবহতাকেও ম্লান করে দিতে পারে। নদী নিয়ে জোরালো ভূমিকার অপেক্ষা আর প্রত্যাশাই সফল হতে পারে নদীকৃত্য দিবসের ভাবনা।
লেখক- সমাজচিন্তক, গবেষক ও সংগঠক।